পরিকল্পিত নদী শাসনে কপোতাক্ষ বাঁচবে

পরিকল্পিত নদী শাসনে কপোতাক্ষ বাঁচবে
  • রিয়াদ হোসেন

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে প্রায় সাতশ নদনদী। এসব নদনদীর উপর নির্ভর করে চলে হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা। আর বিশেষ করে দেশের উপকূলবর্তী এলাকার বেশিরভাগ মানুষ মৎসজীবী। কখনও মাছ আবার কখনও কাঁকড়া শিকার চলে তাদের দৈনন্দিন জীবন। অন্যদিকে নদীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নদীকে ব্যবহার করা হতো। দেখা গেছে, পৃথিবীর বেশিরভাগ সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমীয় সভ্যতা, নীল নদের নিম্নভূমি অঞ্চলে মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। তেমনি আমাদের দেশেও বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলীসহ অন্যান্য নদীগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অধিকাংশ ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র। দেশের আনাচে-কানাচে বয়ে যাওয়া এসব নদ-নদীর মধ্যে অন্যতম একটি নদ হলো কপোতাক্ষ। যেটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বয়ে চলেছে। নদটি যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় ভৈরব নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার খোলপটুয়া নদীতে গিয়ে পতিত হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে যশোর, সাতক্ষীরা এবং খুলনা তিনটি জেলার ওপর দিয়ে নদটি প্রবাহিত হয়েছে।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত এই কপোতাক্ষ নদকে ঘিরে একটি সময় এ অঞ্চল কৃষিতে বেশ সমৃদ্ধ ছিলো। যেসময় নদের জোয়ার-ভাটা স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতো আর কলকল-ছলছল শব্দ শুনে কবি তার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন। যেহেতু কৃষিকাজে সবথেকে পানির প্রয়োজন বেশি সেহেতু মানুষ বর্ষা মৌসম বাদে বাকি সময়ে নদের উপর নির্ভর করে কৃষিকাজ করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এই জনপদের ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষ নদটি মৃতপ্রায়। জোয়ারের পলিমাটি আর অবৈধ দখলদারত্বের কারনে নদে স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কেবল মাত্র আমাদের অবহেলা, উদাসীনতার কারনেই নদটি আজ মরুভূমিরতে পরিণত হতে চলেছে। ইতোমধ্যে এ নদটি বাঁচানোর জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছে; কিন্তু আসলে তা কোন কাজে আসেনি। মাঠপর্যায়ের গিয়ে দেখা গেছে তার ফলাফল মোটেও সন্তুষ্টিজনক নয়। এজন্য এ জনপদকে বাঁচাতে, কৃষিকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষদের জীবন-জীবিকা রক্ষায় কপোতাক্ষ নদকে পরিকল্পিতভাবে শাসন করে বাঁচানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। আষাঢ়-শ্রাবন মৌসুমে যখন দেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত কিংবা প্রবল বৃষ্টিপাত হয় তখন পানি নামার জায়গা পাওয়া যায় না। মাসের পর মাস জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফসল, গৃহপালিত পশুপাখি আর পরিবারের বয়োবৃদ্ধ নিয়ে শুরু হয় মানবেতর জীবনযাপন। আর দেখা দেয় খাবার পানির তীব্র সংকট। যা প্রতিবছরই কমবেশি এ জনপদের মানুষ সম্মুখীন হয়ে আসছে। বিশেষ করে পরিকল্পিতভাবে নদী শাসন করতে না পারার কারনে নদীপথে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ে এই মৃতপ্রায় নদনদীও অন্যতম একটি কারন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি, ইতোমধ্যে এ নদকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষে সরকার কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়) নামে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকার অনুমোদন দেয়। বর্তমানে কপোতাক্ষ নদের খনন কাজ প্রায় শেষের পথে। কিন্তু নদটি খননের পর বর্তমানে যে খালরূপ ধারণ করেছে তাও হয়তো পনেরো-বিশ বছর টিকে থাকবে- এননটাও বলা যাচ্ছে না।

পরবর্তীতে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এতে সাতক্ষীরার তালায় টিআরএম চালু এবং খনন করে নদীর পুরোনো যৌবন ফেরানোর চেষ্টা করা হলেও তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। দ্বিতীয় প্রকল্পের টিআরএম ব্যবস্থা পুনরায় বাস্তবায়নে আর কোন অগ্রগতি দেখা যায় নি। জনগণের দাবীর মুখে এই বিলের পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কারের লক্ষ্যে বর্তমানে টিআরএম বিলের সংযোগ খালের মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যা সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। আর এদিকে প্রকল্পের টাকায় কপোতাক্ষের বুক খননের পর নদটি একটি খালে পরিণত হয়েছে। এর অন্যতম একটি কারন হলো নদীর চরিত্র কিংবা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহন না করা। আমরা জানি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সব নদনদীর বৈশিষ্ট্য এক নয়। কোন নদী পলি বেশি ধারন করে আবার কোন নদী কম। অনেক নদী খরস্রোতা আবার অনেক নদীতে সারাবছর সমান তালে পানির প্রবাহ চলতে থাকে। তাই নদী শাসনে এসব বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরী ছিলো; কিন্তু সেগুলো মাঠপর্যায়ে করা হয়নি। বিশেষ করে আমাদের দেশে খাল এবং নদ-নদী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করে। এতে কপোতাক্ষ নদের যাবতীয় পরিকল্পনা নেওয়া যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায়। কিন্তু তাদের এসব পরিকল্পনা মাঠপর্যায়ের এসে কোন সুফল বয়ে আনতে পারে না। তাদের সংরক্ষিত তথ্যাদি এবং পরিকল্পনা গ্রহনে নানা সীমাবদ্ধতা থাকায় এতোদিনেও কপোতাক্ষকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয় নি।

এজন্য কপোতাক্ষকে জীবিত করে এ অঞ্চলকে আবার সমৃদ্ধ করে তুলতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মৎস এবং কৃষি খাতে আবারো সুদিন ফেরাতে আমদানি নির্ভর জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর তার জন্য পরিকল্পিতভাবে নদী শাসন করতে হবে; যাতে সহজে নদনদী থেকে পানি কাজে লাগানো যায়। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সরকারের এ বিভাগকে আরো স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার জায়গায় আনতে হবে। সুশাসনের অঙ্গীকার নিয়ে তাদের কাজ করাতে হবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যায় ঘনবসতি, পানি দূষণ, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে কপোতাক্ষকে বাঁচাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে হবে। এরপর বিভিন্ন সময়ে বাঁধ দিয়ে নদী কাটার চেষ্টা, বেড়িবাঁধ তৈরি করে কপোতাক্ষ ভরাটের এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যেগুলো প্রশাসনের দৃষ্টিতে আনা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি বাজেটকৃত টাকা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মধ্যে দিয়ে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যেতে পারলে কপোতাক্ষকে বাঁচানো সম্ভব হবে।

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যদের পড়ার সুযোগ করে দিন।

আমাদের ফেসবুক পেজ

আজকের দিন-তারিখ

  • শনিবার ,রাত ৮:৪৮
  • ২৭ জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১২ শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  • ২১ মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিন